পরলোকে জেরেমায়া স্টেমলার (Jeremiah Stemler)। ১০২ বছরে তাঁর ঘটল মহা প্রয়াণ। তাঁর নাম শুনেছি আমি যখন কোলেস্টেরল আর হৃদরোগ নিয়ে গবেষণা শুরু করি আমি তখন আইপিজিএমআর-এ। তাঁকে বলা হয় প্রতিরোধক হৃদবিদ্যার (প্রিভেন্টিভ কার্ডিওলজির) জনক। ডায়েট আর হৃদ স্বাস্থ্য নিয়ে তাঁর ছিল ব্যাপক গবেষণা।
আমার ৮০ দশকে বিলেতে যখন এ নিয়ে গবেষণা তখন তাঁর গবেষণা প্রবন্ধগুলো আমার জন্য খুব সহায়ক হল। আমার একটি আবিষ্কার কোলেস্টেরল মান কমাবার জন্য একটি বহুমুখী খাদ্য ব্যবস্থাপনা (A MULTIFACTORIAL DIET TO LOWER LIPID LEVEL ) কাজটি বেশ প্রশংসা কুড়াল সে সময় আর আমার অধ্যাপক যার পর নাই খুশি হলেন কারণ আমি জেনেছিলাম আমার অধ্যাপক বেরি লুই ছিলেন কোলেস্টেরল কমাবার জন্য ডায়েটের পক্ষে তাই আমি গবেষণায় এই বিষয় বেছে নেয়াতে তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন, আর পুষ্টিবিদ ড. পেনি জ্যাকসন আমাকে সহ গবেষক হিসাবে অনেক সাহায্য করলেন। একটা কথা বলি পেনি ছিলেন রেজিস্টার্ড নার্স আর ডায়েটিসিয়ান। আবার পিএইচডি, দারুণ জ্ঞানী। সে দেশে নার্সদের জ্ঞান আর দক্ষতা দেখলে অবাক হবার মত। ওয়ার্ডে রোগী ব্যবস্থাপনায় তারাই সর্বেসর্বা আর তা হয়েছে যোগ্যতায়।
এদিকে বিলেতে সার্জন ম্যাকমাইকেল ছিলেন কোলেস্টেরল কমাতে ডায়েটের বিপক্ষে আর ওষুধ প্রয়োগের পক্ষে আর এনিয়ে দুজনের বেশ দ্বন্দ্ব ছিল।
যা হোক সেই কাজ করতে গিয়ে আমার অনেক বিজ্ঞানীর সঙ্গে পত্র বিনিময় হল আর দেখা সাক্ষাত হল নানা বৈজ্ঞানিক অধিবেশনে। আমার জ্ঞান সমৃদ্ধ হল। এই আমার প্রাপ্তি। জেরেমায়া স্টেমলারের সাথে পত্রালাপ আমার প্রাপ্তি। ৭০ দশকে হৃদরোগের ঝুঁকি উপাদান কোলেস্টেরল, রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ধূমপান তাঁর অবদান। তাঁর ইন্টার সল্ট স্টাডি লবণের সাথে রক্তচাপের সম্পর্ক বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। ডায়েট আর হৃদরোগের সম্পর্ক তার এক বিশাল অবদান।
আমার এই গবেষণায় তাঁর সঙ্গে অনেক পত্রালাপ হয়েছে। যেমন হয়েছিল ড. জর্জ ভি ম্যানের সাথে আমার দধি খাইয়ে কোলেস্টেরল কমানোর গবেষণার সময়। আফ্রিকার মাসাই উপজাতির এই পর্যবেক্ষণ আমাকে উদ্বুদ্ধ করে এই গবেষণায়।
আমাদের দেশে একটি ঔপনিবেশিক নিয়ম আছে যাকে তাকে যেকোন সময় বদলী করা যেমন বিলেত থেকে এসেছি, প্রেসিডেন্ট তখন জেনারেল এরশাদ, আমাকে বদলি করা হল মেডিকেল কলেজে অথচ আমি ছিলাম আইপিজিএমআর-এ। গবেষণা গুছিয়ে আনছি আর লিপিড নিয়ে আরও গবেষণার প্রশস্ত করব এমন এক আশ্বাস পেয়েছি বিলেত থেকে এমন সময় দৃশ্যপট বদল। কথা নেই বার্তা নেই যেন আমরা কেরানি বা মসিজীবী যেকোন স্থানে গেলেই কাজ করা যাবে। সে সময় আমি একথা বুঝালেও আমার আবেদন গ্রাহ্য হল না।
এখন অবশ্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কল্যাণে চারটি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে আর সেখানকার শিক্ষকেরা বদলি হবেন না তাই তারা গবেষণা করতে পারেন নিরবিচ্ছিন্নভাবে। এই প্রথম দেখলাম প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসা গবেষণার গুরুত্ব নিয়ে কথা বললেন, আগে আমি কারো মুখে শুনিনি।
বিদেশে এমন বদলি এরা কল্পনা করে না আর সবাই জানি গবেষণায় ছেদ পড়লে বা অবস্থান পরিবর্তনে গবেষণার ধারাবাহিকতা না থাকলে বিদেশের বিজ্ঞানীর সাথে যোগাযোগ থাকে না।
আমার অভিজ্ঞতা হয়েছে যারা আমাদের বদলি আর পদায়ন করেন তারা ডাক্তারের চাকরি বলতে রোগী দেখা বুঝেন, শিক্ষকতা বা গবেষণা এসব তারা বুঝেন না, বরং এমন ধারণা ডাক্তার আবার গবেষণা করবে কি! অত রোগী দেখবে, চিকিৎসা করবে। এমন একটি ধারণা কার্যে পরিণত হওয়াতে যে মেধাবি গবেষণা ইচ্ছুক তরুণ সে গ্রামে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরতে ঘরতে আর এরপর পোস্ট গ্রাজুয়েট করার ধকল সামলানোর পর আর নানাভাবে স্পিড মানি দেবার পরও ব্যর্থ হয়ে মিশে যায় সবার পথে, গড্ডালিকায় সামিল হয় বা বিদেশে পাড়ি জমায়।
আমাদের দেশে চিকিৎসা গবেষণার এই অধোগতির জন্য একটি প্রবহমান চিন্তার দৈন্য কাজ করেছে। এ দিক অনেক বুঝতে চান না। গবেষণা দেশে চিকিৎসা বিজ্ঞানে কেন হল না এ হল এক কারণ আর মুড়ি মুড়কি এক দর হলে যা হয়।
তবে আমি আশাবাদি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন হবে গবেষণার কেন্দ্র, মেডিকেল কলেজ বা জেনারেল হাসপাতালের মত অনেক রোগী দেখার কেন্দ্র হবে না, এ হবে একাডেমিক হাসপাতাল, শিক্ষা, উন্নত প্রযুক্তি আর গবেষণা হবে প্রধান। আমার ধারণা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ কারণেই গবেষণার দিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন তারা নিশ্চয় জাতির এ আশা পূরণ করবেন।
জেরেমায়া স্টেমলার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে অনেক কথা এল, হয়ত প্রাসঙ্গিক নয় অতটা কিন্তু বয়স হয়েছে আর অতীতের অনেক কথা মনে উঠে আসে আর প্রবীণদের মধ্যে আমি একজন হওয়াতে কিছু কথা বলার প্রয়োজনও বোধ করি। আমার জীবনের এই শেষ বেলায় মনে হয় আমাদের বুদ্ধি আর চিন্তার মুক্তি ঘটা অনেক দেরী। বঙ্গবন্ধু যে মুক্তির কথা বলেছেন সে দিকে আমরা চলছি কি না জানিনা। আর ঔপনিবেশিক নিয়ম কানুন ব্যবস্থা আমরা সযত্ন লালন করে ক্ষেত্র বিশেষ পালন আর বর্ধন করে এর পথে কি আমরা হাঁটছি? আমাদের কি মোহমুক্তি দরকার কিন্তু সাম্প্রতিক বিশ্বের সাথে আমরা কি করে তাল মিলাব? আমরা এত ব্যস্ত নিজের দিকে তাকাবার নিজেকে একান্তে অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার ফুরসত পাই না। আমরা কত বেশি কত পরিমাণ হবে কতগুলো হবে, পাব এ নিয়ে চিন্তায় অস্থির কিন্তু মানসম্মত কয়টি এ নিয়ে তেমন উদ্বেগ নেই।
ইস্ট ইনডিয়া কোম্পানি দেশ শাসনের যে নিয়ম কানুন করেছিল তা আমরা আসলে কি বদলাতে চাই? আমি বিলেতে গিয়ে অন্য রকম দেখছি লর্ড ক্লাইভ আর কর্ণওয়ালিসের ছায়া বা অপচ্ছায়া দেখিনি। বরং যারা ওদেশের লোক এদেশে এসেছে তারা আমাদের এই ঔপনিবেশিক ধারা বহমান দেখে বিস্মিত হয়।