স্বপ্নের রসায়ন!

স্বপ্ন কি?
মানুষ কেন স্বপ্ন দেখে?
স্বপ্ন কি কেবলই স্বপ্ন,না কোন কিছুর ইংগিতবহ?
মানুষই কেবল স্বপ্ন দেখে?
না, অন্যান্য প্রানীও স্বপ্ন দেখে?
জন্মান্ধরা কি স্বপ্ন দেখে?
বোবা বা প্রতিবন্ধি মানুষরাও কি স্বপ্ন দেখে?
স্বপ্ন নিয়ে মানুষের প্রশ্নের শেষ নেই!
এর সোজাসাপটা কোন উত্তরও নেই!

তবে গবেষণায় দেখা গেছে, অন্ধরাও স্বপ্ন দেখে!যারা পাঁচ থেকে সাত বছর বয়সের আগেই অন্ধ হন, তারা তাদের স্বপ্নে দৃশ্যমান কোনো কিছুই দেখতে পান না। তাদের শুধু কিছু দেখার মতো অনুভূতি হয়। তারা ঘ্রান পান! ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর তারা কী দেখেছেন, তা মনে করতে পারেন না। আর মনে করতে পারলেও তার বর্ণনা দিতে পারেন না। তাদের এই অনুভূতিগুলো সাধারণ মানুষের অনুভূতির চেয়ে তীব্রভাবে অনুভূত হয়। আসলে যারা পাঁচ/সাত বছর বয়সের মধ্যে অন্ধ হন, তারা তাদের চারপাশের জগতের সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত হতে পারেন না। পারিপার্শ্বিক অবস্থা নিয়ে তাদের চিন্তার জগতটাও সংকুচিত। তাই তাদের স্বপ্নের জগতটাও সীমিত পরিসরের! তবে ক্ষেত্র বিশেষে এর ব্যতিক্রমও পরিলক্ষিত হয়।

প্রাণীর উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর পর ধারনা করা হচ্ছে যে: প্রাণীরাও স্বপ্ন দেখে। এ ধারনার পেছনে রয়েছে একই রকম দেখতে কিছু ব্রেইন ওয়েভ যা মানুষের ঘুমন্ত অবস্থায় স্বপ্ন দেখার সময় তৈরি হয়। আপনার পোষা প্রাণীটিকে ঘুমন্ত অবস্থায় খেয়াল করুন, দেখবেন সেটি ঘুমন্ত অবস্থায় থাবা নাড়ায়, মুখে শব্দ করে বা এমন কোন ভঙ্গি করে যা দেখে মনে হতে পারে সে কারও সাথে কথা বলছে বা স্বপ্ন দেখছে!

১৯০০ এর দশকের প্রথম দিকে সিগমুন্ড ফ্রয়েড স্বপ্নের তত্ত্ব ও তাদের ব্যাখ্যা সম্পর্কে ব্যাপকভাবে লিখেছিলেন। তিনি স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছিলেন:

স্বপ্ন হচ্ছে গভীরতম আকাঙ্ক্ষা এবং উদ্বিগ্নতা প্রকাশের মাধ্যম! যা প্রায়ই দমনমূলক শৈশব স্মৃতি বা আচ্ছন্নতা সম্পর্কিত! অধিকন্তু, তিনি বিশ্বাস করতেন যে: বস্তুগতভাবে স্বপ্নের বিষয়টি অবশ্যই যৌন উত্তেজনা মুক্তির প্রতিনিধিত্ব করে।’Interpretation of Dreams’ এর মধ্যে, ফ্রয়েড স্বপ্ন ব্যাখ্যা করার জন্য একটি মানসিক কৌশলকে বিকশিত করেছিলেন!

পঞ্চম খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে এন্টিফন, স্বপ্ন নিয়ে প্রথম গ্রীক বই লিখেছিলেন। সেই শতাব্দীতে, অন্যান্য সংস্কৃতি গ্রিকদের বিশ্বাসকে প্রভাবিত ছিল! এন্টিফন লিখেছিলেন:

‘আত্মাঘুমানোর সময় শরীর ছেড়ে চলে যায়’!হিপোক্রেটাস স্বপ্ন নিয়ে একটি সহজ তত্ত্ব দিয়েছিলেন: দিনের বেলা মানুষের আত্মা স্বপ্ন সংক্রান্ত চিত্র গ্রহণ করে এবং রাতের বেলা পূর্ণাঙ্গ একটি ছবিতে রূপদান করে। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বিশ্বাস করতেন:
‘স্বপ্ন হল শারীরিক কার্যকলাপ। তিনি মনে করতেন স্বপ্ন রোগের বিশ্লেষণ এবং কোন ধরনের রোগ হতে পারে তার জন্য ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে’!

মার্কাস টুলিয়াস সিসেরো বিশ্বাস করতেন যে স্বপ্ন মূলত তাই যা স্বপ্নদর্শী দ্বারা পূর্বের দিনগুলিতে আগেই চিন্তা করা হয়েছিল।
মেসোপটেমিয়ার লোকদের বিশ্বাস ছিল:

‘আত্মা বা তার কিছু অংশ ঘুমন্ত ব্যক্তির শরীর থেকে বেরিয়ে আসে যা প্রকৃতপক্ষে ঐসব স্থান এবং ব্যক্তিদের মধ্যে ঘুরে বেড়ায় যা স্বপ্নদর্শীরা তাদের ঘুমের মধ্যে দেখে । কখনও কখনও স্বপ্নের দেবতারা স্বপ্নদর্শীকে বহন করতে বলে’!
ব্যাবিলনীয়রা এবং আসিরিয়ানরা স্বপ্নকে বিভক্ত করেছিল ভাল আর মন্দ দু’ভাবে।’ভাল স্বপ্ন’ যা দেবতাদের দ্বারা প্রেরিত! আর ‘মন্দ স্বপ্ন’ যা ভূতদের দ্বারা পাঠানো হয়েছিল।তারা এও বিশ্বাস করতো যে তাদের স্বপ্ন ছিল নিখুঁত এবং ভবিষ্যদ্বাণী সংবলিত!
২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে প্রাচীন মিশরে মিশরীয়রা তাদের স্বপ্নগুলোকে প্যাপিরাসে লিখে রাখতো!

মিশরীয়রা বিশ্বাস করতেন:
‘স্বপ্ন দেবতাদের কাছ থেকে বার্তা নিয়ে আসার মত শব্দগুচ্ছ।
তারা মনে করতেন:
‘ঐশ্বরিক সান্নিধ্য লাভের সর্বোত্তম উপায় হলো স্বপ্ন দেখা।তাই মিশরীয়রা দেবতাদের কাছ থেকে পরামর্শ, সান্ত্বনা, বা নিরাময় পাওয়ার আশায় বিশেষ ধরনের ‘স্বপ্নের বিছানা’য় ঘুমাতেন!
চীনা ইতিহাসে, মনুষ্য আত্মার দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্পর্কে লিখা হয়েছিল:
‘যার মধ্যে একটি স্বপ্নের রাজ্যে যাত্রার সময় শরীর থেকে মুক্তি পায় এবং অন্যটি দেহে অবস্থান করে,’!
যদিও শুরু থেকেই এই বিশ্বাস ও স্বপ্নের ব্যাখ্যা দার্শনিক ওয়াং চং-র দ্বারা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল।

৯০০ এবং ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে লিখিত ভারতীয় পাঠ উপনিষদে স্বপ্নের দুটি অর্থের উপর জোর দেওয়া হয়েছিল:
প্রথমটি বলে:
‘স্বপ্ন হল মনের ভিতরের নিছক ইচ্ছার অভিব্যক্তি মাত্র’!
দ্বিতীয়টি হচ্ছে:
‘ঘুমের সময় আত্মা দেহ ত্যাগ করে এবং জাগ্রত হওয়ার আগ পর্যন্ত ঐটি দ্বারা দেহ পরিচালিত হয়’!
কিছু আদিবাসী আমেরিকান উপজাতি এবং মেক্সিকান সভ্যতার লোকেরা বিশ্বাস করতেন যে:
‘স্বপ্ন হল একটি উপায় যার মাধ্যমে তারা তাদের পূর্বপুরুষদের দেখতে এবং তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে’!
কয়েকটি আদি আমেরিকান উপজাতি স্বপ্নের মাধ্যমে উপদেশ গ্রহণ না করা পর্যন্ত উপবাস ও প্রার্থনা করে। স্বপ্ন থেকে প্রাপ্ত উপদেশ তারা বাকিদের সাথে শেয়ার করে।
মধ্যযুগে স্বপ্নের ইমেজ গুলোকে শয়তান এর প্রলোভন হিসাবে মনে করা হত। অনেকে বিশ্বাস করতেন যে, ঘুমের সময় শয়তান মানুষের মনকে কলুষিত ও ক্ষতিকারক চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত করতে পারে!

স্বপ্ন নিয়ে এত আলোচনা হবার পরেও স্বপ্ন অমিমাংশিত থেকেই গেছে।আমরা এখনও বুঝে উঠতে পারিনি স্বপ্নের আসল রসায়ন!

লেখক

ডা. সিনহা মনসুর
Stony Brook, New York

SELLULAR Health

Follow us

Don't be shy, get in touch. We love meeting interesting people and making new friends.