২০২১, বিশ্ব স্বাস্থ্যখাতের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। বিশ্বের নানা দেশসমূহ একদিকে যেমন করোনা মহামারীর মৃত্যহার কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে, ঠিক একইসাথে অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবাসমূহের মান সমুন্নত রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে। বরাবরের মতই স্বাস্থকর্মীরা এই সেবার সিংহভাগ দায়িত্ব পালন করেও যথোপযুক্ত স্বীকৃতি লাভ করেন নি। উন্নত দেশগুলোতে কোভিড এর চিকিৎসা এবং ভ্যাক্সিনেশান পূর্ণগতিতে এগুলেও,অনুন্নত দেশগুলোর বেশিরভাগই বঞ্চিত হয়েছে। অন্যান্য রোগসমূহ,যেমন ডায়াবেটিস থেকে শুরু করে ডিমেনশিয়া পর্যন্ত অনেক রোগের চিকিৎসাই অনেক বাধা বিপত্তি স্বত্ত্বেও সাফল্য অর্জন করেছে।
চলুন দেখে নেওয়া যাক, ২০২১ সালে বিশ্বস্বাস্থ্যখাতের জানা-অজানা ১০ টি অর্জন
১) কোভিড ১৯ এবং বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্যখাতে বিরাজমান বৈষম্য
প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে যে বৈষম্য রয়েছে, তা এই বছর আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে।
সারাবিশ্বে ৪ বিলিয়নের বেশি কোভিড ১৯ ভ্যাক্সিনের ডোজ দেয়া হলেও, নভেম্বরের শেষ নাগাদ পর্যন্ত আফ্রিকার প্রতি ৪ জন স্বাস্থ্যকর্মীর মাত্র ১ জন ডোজ সম্পূর্ণ করেছেন।সারা বিশ্বের মাত্র ০.৪% কোভিডের পরীক্ষা নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে করা হয়েছে।
কোভিড ১৯ মোকাবেলায় এই বৈষম্য দূর করে বিশ্বব্যাপী চিকিৎসায় সাম্য বজায় রাখতে WHO গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে। আমরা বিশ্বব্যাপী Vaccination এর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি এবং সকল দেশের স্বাস্থ্যকর্মী এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী যাতে অগ্রাধিকার পায় সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।২০ ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত আমরা ১০ টি কোভিড ১৯ ভ্যাক্সিন কে নিরাপদ এবং কার্যকরী হিসেবে অনুমোদন দিয়েছি যা প্রকৃতপক্ষে প্রতিফলিত করে প্রতিনিয়ত আমরা নিজেদের কতটা আপডেটেড করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
সকলের সম্মিলিত সহযোগীতা নিশ্চিত করাই জাতিসংঘের প্রধান লক্ষ্য। জাতিসংঘের Research and Development Blueprint এর অধীনে বিশ্বের মেধাবী বিজ্ঞানীরা কোভিড ১৯ মোকাবেলায় একত্রিত হয়ে কাজ করছেন।ACT-Accelator টিম দ্রুত কোভিড ১৯ পরীক্ষার খরচ অর্ধেক কমিয়ে নিম্ন এবং নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে সহযোগীতা করেছেন এবং ১৪৮ মিলিয়নের বেশি নমুনা পরীক্ষার জন্যে সংগ্রহ করেছেন।ভ্যাক্সিন উৎপাদন থেকে সরবরাহ পর্যন্ত নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে জাতিসংঘ বিশ্বব্যাপী এক বিলিয়ন ডোজের তিন চতুর্থাংশের বেশি বিতরণ করেছে,যা নি:সন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।
WHO ” mRNA technology transfer hub ” নামে একটি উদ্যোগও চালু করেছে এবং এই অঞ্চলে পরিষেবা দেওয়ার জন্য উৎপাদন ক্ষমতা বিকাশের জন্য জ্ঞান, তথ্য এবং প্রযুক্তিকে একত্রিত করতে দক্ষিণ আফ্রিকার একটি নির্মাতাকে সহায়তা করেছে।
COVID-19 প্রযুক্তি অ্যাক্সেস পুল তার প্রথম লাইসেন্স ঘোষণা করেছে,যা নি:সন্দেহে একটি স্বচ্ছ এবং বৈশ্বিক চুক্তির অনন্য উদাহরণ স্থাপন করেছে। এর মাধ্যমে জাতিসংঘ বিশ্বের সমস্ত দেশকে স্প্যানিশ ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিল দ্বারা তৈরি একটি সেরোলজিক্যাল পরীক্ষার অনুমোদন দিবে।
কোভিড ১৯ মোকাবেলায় দূরদর্শীতার প্রমানস্বরুপ জাতিসংঘ বেশ কিছু প্রস্তুতিমূলক পন্থা অবলম্বন করেছে,যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জার্মানীর বার্লিনে Pandemic and Epidemic Intelligence hub খোলা।এছাড়াও দ্রুত এবং নিরাপদে প্যাথোজেন সমূহ পরীক্ষার জন্যে সুইজারল্যান্ডে একটি Hub খোলা হয়েছে যা বিশ্বব্যাপী কোভিড মোকাবেলায় সকলের প্রস্তুতি বাড়াতে এবং ঝুঁকিসমূহ মূল্যায়ন করতে সাহায্য করবে।
বিশ্বের অনেক দেশই কোভিড ১৯ এর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এই টুলটি ব্যবহার করেছে এবং নানাভাবে একে শক্তিশালী করেছে। পাশাপাশি,সার্বজনীন স্বাস্থ্য এবং প্রস্তুতি পর্যালোচনার পাইলট রোলআউট সফলভাবে দেশগুলিকে তাদের জনসংখ্যার সামগ্রিক স্বাস্থ্যের জন্য প্রদান এবং প্রচার করার সময় পরবর্তী মহামারীর জন্য তাদের প্রস্তুতি মূল্যায়ন করার জন্য একে অপরের কাছ থেকে শেখার জন্য নিয়োগ করেছে।
২) উদ্ভুত জরুরী অবস্থাসমূহ অব্যাহত থাকা
মহামারী ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে, WHO এবং তার সহযোগী অংগসংগঠনসমূহ আফগানিস্তান এবং উত্তর ইথিওপিয়ার উদীয়মান সমস্যার প্রতিকারের চেষ্টার পাশাপাশি ইয়েমেন এবং সিরিয়ার মতো দীর্ঘ মানবিক সংকটে আটকে থাকা সম্প্রদায়গুলিকে সাহায্য করা অব্যাহত রেখেছে।
ইয়েমেনে, যে দেশটি ইতিমধ্যেই যুদ্ধ এবং অন্যান্য রোগের প্রাদুর্ভাবে জর্জরিত,সেখানে Covid 19 দেশটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরও নাজুক অবস্থায় ফেলে দিয়েছে,উপরন্তু সে দেশের স্বাস্থ্যসেবা সুবিধাগুলির মাত্র অর্ধেক কার্যকরী হিসাবে জানা গেছে। তীব্র অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং therapeutic feeding সেন্টারে সহায়তা করে WHO যথাসাধ্য সাহায্য করেছে। মহামারীর মোকাবেলায় প্রস্তুতি হিসেবে, WHO অক্সিজেন উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ, স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের জন্য আরো প্রশিক্ষিত করা, চিকিৎসা ও প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জামের ব্যবস্থা এবং ল্যাবরেটরি ও পরীক্ষার ক্ষমতা জোরদার করার বিষয়ে কাজ করেছে।
এক দশকের বেশি সময় ধরে যুদ্ধ চলে আসায় সিরিয়াতে সাহায্যের দরকার আরো বেশি জরুরী হয়ে পড়েছে। WHO স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের পাশাপাশি তার অংগ সংঠনের সহায়তায় সেদেশের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতিও গুরুত্বারোপ করছে।
আফগানিস্তান, কোভিড এর পাশাপাশি ডায়রিয়া,ডেংগু,হাম,পোলিও এবং ম্যালেরিয়া সহ অনেকগুলো রোগের সাথে যুদ্ধ করছে। WHO ১৫ আগস্ট ২০১১ সাল থেকে ৪১৪ মেট্রিক টন জীবনরক্ষাকারী চিকিৎসা উপাদান সরবরাহ করেছে এবং অংশীদারদের সাথে নভেম্বরে ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে 8.5 মিলিয়ন শিশুকে পোলিওর বিরুদ্ধে টিকা দিয়েছে।
জ্বালানি, খাদ্য এবং ওষুধের অভাব সহ – গুরুতর সমস্যাগুলো উত্তর ইথিওপিয়ার মানুষকে আরো অসহায় করে তুলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইথিওপিয়ায় এখন পর্যন্ত 367 মেট্রিক টন সাহায্য সরবরাহ করেছে,যার মাধ্যমে কয়েক হাজার পরিবারকে ত্রাণ দেওয়া হয়েছে। অংগসংঠন এর সাহায্যে একসাথে, আমরা টাইগ্রে অঞ্চলে কলেরার বিরুদ্ধে ২০ লক্ষ মানুষকে টিকা দেওয়ার জন্য একটি ক্যাম্পেইন ও শুরু করেছি। আমরা যুদ্ধ বিধ্বস্ত আফার, আমহারা এবং টাইগ্রে অঞ্চলে অভ্যন্তরীণভাবে গৃহহীন মানুষদেরর সেবা প্রদানের জন্য স্থানীয় ছোট ছোট দলগুলোকেও সাহায্য প্রদান করেছি।
৩) নারীদের অবদান এবং অর্জন
গত দুই বছরের স্বাস্থ্যখাতের চ্যালেঞ্জ সামলাতে নারীর অবদান অনস্বীকার্য,কারণ WHO মোট কর্মশক্তির প্রায় ৭০% ই নারী। WHO নারী স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজের যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি এবং তাদের শিক্ষার প্রসারে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
বিজ্ঞানের অগ্রগতিতেও নারীরা অবদান রাখছেন। WHO সকল ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে এবং তাদের জ্ঞানের সীমানা প্রসারণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী এবং নেতা হিসাবে নারীদের চ্যাম্পিয়ন করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।এ লক্ষ্যে WHO গ্লোবাল হেলথ নেটওয়ার্কে নারীদের সাথে একটি MoU স্বাক্ষর করেছে এবং নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে বিভিন্ন কর্মসূচী হাতে নিয়েছে।
অতীতে যাঁরা গবেষণায় অবদান রেখেছিলেন,তাঁদেরকেও পুরস্কৃত করা হচ্ছে।উদাহরণস্বরূপ,হেনরিয়েটা ল্যাকস নামের একজন মহিলাকে মরণোত্তর সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে।।১৯৫১ সালে তাঁর সার্ভিকাল ক্যান্সার চিকিৎসার সময় তাঁর অজান্তেই টিউমারের নমুনা সংগ্রহ করা হয় যা পরবর্তীতে প্রায় ৭৫,০০০ গবেষণায় ব্যবহৃত হয়। মাত্র ৩১ বছর বয়সে তাঁর জীবনাবসান ঘটলেও তাঁর অবদান বিভিন্ন আবিষ্কারের পথকে সহজ করে।
কিন্তু দু:খের ব্যাপার হচ্ছে মহামারীর কারণে বিভিন্ন পরিষেবা ব্যাহত হওয়ায় নারীরা আরো বেশি অসমতা এবং লিংগভিত্তিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছেন।
নারীর প্রতি সহিংসতার ব্যাপকতার উপর এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩ জনের মধ্যে ১ জন মহিলা তার নিজের সঙ্গীর দ্বারা শারীরিক বা যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন বা অপরিচিত কারো কাছ থেকে যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন।মহামারীর দরুন প্রতি গৃহেও নারীর প্রতি সহিংসতার হার বেড়েছে। জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে এসব সহিংসতা কমিয়ে আনতে WHO আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে।
নারীস্বাস্থ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে WHO জরায়ুমুখের ক্যান্সার প্রতিরোধে বিভিন্ন কর্মসূচী হাতে নিয়েছে যার মধ্যে সার্ভিকাল স্ক্রিনিং এর নতুন নির্দেশিকা প্রকাশ,ভ্যাক্সিনেশান,স্বাস্থ্যসেবা গ্রহনে সমতা নিশ্চিত -এসব উল্লেখযোগ্য।স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীদের মৃত্যুহার হ্রাস করার লক্ষ্যেও WHO যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
চলবে…