আইবিএস (IBS, Irritable Bowel Syndrome) কে সহজ ভাষায় বলা যায় দীর্ঘমেয়াদি পেটের পীড়া। এটি মানবদেহের কোলনের একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ, যেখানে রোগী বারবার পেটে ব্যাথা এবং বাউয়েল হ্যাবিটের পরিবর্তন নিয়ে কমপ্লেইন করে; যা মূলত কোলনের কিংবা বৃহদান্ত্রের স্বাভাবিক কাজের ব্যাঘাতের কারণে হয়ে থাকে।
ইংরেজিতে সিনড্রোম শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে একটি রোগের বিভিন্ন উপসর্গ বা লক্ষণের সমষ্টি। IBS এ রোগী অনেক গুলো Physical Symptoms নিয়ে আসে,যেগুলো কে Organic বা Pathophysiologically ব্যাখ্যা করা যায় না। অর্থাৎ এক্ষেত্রে বৃহদানন্ত্রের স্বাভাবিক ফাংশন কোনো অর্গানিক বা প্যাথলজিক্যাল কারণ ছাড়াই পরিবর্তন হয়; যথা কোলনের অভ্যান্তরীন কোনো ইনফ্লামেশন কিংবা প্রদাহ ছাড়াই। তাই একে ফাংশনাল বাউয়েল ডিসঅর্ডার ও বলা হয়।
কাদের বেশী হয়?
গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টিনাল রোগের মধ্যে এটি সবচেয় বেশী দেখা যায়। প্রতি ১০০ জনে ১০-১৫ জন এই রোগে ভোগে থাকেন। ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা দুই থেকে তিনগুণ বেশি আক্রান্ত হয়। IBS এর সাথে সাধারণত Fibromyalgia, Chronic Fatigue Syndrome, NUD(non-ulcer dyspepsia)এই রোগ গুলোও দেখা যায়।
কী কারণে এই রোগ হয়ে থাকে?
আগেই বলেছি এই রোগে কোলনের কোন স্ট্রাকচারাল এবনরমালিটি থাকে না।
আর এর কারণ সম্পূর্ণভাবে জানা যায়নি তবে দেখা গেছে Bio psychosocial ফ্যাক্টরস গুলো এরোগে একধরনের ভূমিকা পালন করে। দেখা যায় এ রোগে আক্রান্ত ৫০ শতাংশ রোগী মানসিক সমস্যায় ( Psychiatric Illness যেমন দুশ্চিন্তা, হতাশা) ভোগেন।
অর্থাৎ Stress বা অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা IBS এর অন্যতম কারণ (অনেকের পরীক্ষার সময়ও দুশ্চিন্তার কারণে IBS এর উপসর্গ দেখা দেয়)
নরমাল Gut Flora সমূহের পরিবর্তন যেমন অস্বাভাবিক বৃদ্ধির (Small intestinal Overgrowth) কারণেও এ রোগ হয়।।
ডায়েটরি ফ্যাক্টর যেমন কিছু খাবারের প্রতি ইনটলারেন্স (যেমন দুগ্ধ জাতীয় বা আর্টিফিশিয়াল সুয়েটনার) বা যেসব খাবারএর ফার্মেন্টেশন পেটে গ্যাসের সৃষ্টি করেসেসব খাবার খাওয়ার কারণেও হতে পারে।
কিভাবে বুঝবেন এই রোগ হয়েছে? বা কি কি উপসর্গ দেখা যায়?
অনেকদিন ধরে বারবার পেটে ব্যাথা বা অসস্তিতে ভোগবে। আর এই ধরনের সমস্যার কারণে আগেও ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণের হিস্ট্রি থাকে অনেকের।
অথবা পেটে ভুটভাট শব্দ হওয়া বা খাবারের পর পর পেটফেঁপে যাওয়া। হঠাৎ করে পেট কামড়িয়ে উঠে পায়খানা হওয়া এবং মলত্যাগের পর ব্যাথা কমে যাওয়া।
Bowel habit এ পরিবর্তন হবে অর্থাৎ মল ত্যাগের স্বাভাবিক নিয়ম পরিবর্তন হয়ে যাবে। ঘন ঘন টয়লেটে যাওয়া; কিছুদিন পরপর ডায়রিয়া হওয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য, অথবা কিছুদিন ডায়রিয়া ও কিছুদিন কোষ্ঠকাঠিন্যের সমন্বয়। (ডায়েরিয়ার উপসর্গ বেশি থাকলে, একে বলে Diarrhoea predominant IBS ( IBS-D)। আবার যদি কোষ্টকাঠিন্য কিংবা Constipation বেশী হয় এই প্রকার IBS যেখানে Constipation predominant, তাকে IBS-C বলে)
মিউকাস মিশ্রিত মলত্যাগ হতে পারে( যেটাকে অনেকেই আমাশয় নামে জানে কিংবা তৈলাক্ত পায়খানা হিসেবে)
প্রতিনিয়ত গ্যাস হওয়া এবং ঘন ঘন মলদ্বার দিয়ে গ্যাস বের হওয়া।
খাওয়ার পরই টয়লেটের বেগ হওয়া এবং পায়খানায় যাওয়ার বেগ সামলাতে না পারা
কারো ক্ষেত্রে দেখা যায় নির্দিষ্ট কিছু খাবার ( যেইসব খাবারে Gulten থাকে যেমন ময়দার তৈরি খাবার কিংবা বেকারী জাতীয় খাবার) খেলেই এইরকম উপসর্গ এর শুরু হয়।
কিভাবে নিশ্চিত হবেন?
এরোগ মূলত ক্লিনিক্যালি ডায়াগনোসিস করা হয়। Rome (lll) Criteria মতে, কোনো রোগীকে IBS হিসেবে শনাক্ত করতে হলে মাসে অন্তত ৩ বার বারবার পেটব্যথা বা অস্বস্তির সাথে নিচের লক্ষণগুলোর অন্তত দুটি লক্ষণ তিন মাস পর্যন্ত উপস্থিত থাকতে হবেঃ
১.টয়লেট করলে পেটব্যথা প্রশমিত হবে
২.পায়খানার ধরন পরিবর্তন হবে (যেমন- ডায়েরিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া ও কোষ্ঠকাঠিন্যের সমন্বয় ইত্যাদি)
৩.পায়খানায় যাওয়ার ফ্রিকোয়েন্সী বেড়ে যাওয়া (আগে একবার হলে এখন ৩-৪ বার হয়)।
কোন টেস্ট কি করতে হবে?
IBS কে বলা হয় ডিজিজ অব এক্সক্লুশন। IBS বলতে হলে আগে কোলনের অন্য কোন অর্গানিক ডিজিজ আছে কিনা ল তা এক্সক্লুড করতে হবে। উপসর্গের উপর ভিত্তি করে রক্ত পরীক্ষা আর Stool culture করে কোনো Identifiable ইনফেকশন আছে কিনা তা Exclude করতে হবে।
এছাড়াও যাদের বয়স ৪০ এর উপর এবং
Inflammatory bowel disease (IBD) নামে একটা রোগের কারণেও IBS এর মত উপসর্গ দেখা দেয়, তাই কোলনস্কপি (Colonoscopy) করে তা এক্সক্লুড করতে হবে।
তবে মনে রাখতে হবে যাদের IBS এর উপসর্গের সাথে সাথে যদি
পায়খানার সাথে রক্ত যায়,
শরীরের ওজন দ্রুত কমে যায়,
আর রোগী যদি পুরুষ হয় সাথে বয়স ৫০ বছরের বেশী হয়;
এছাড়াও পরিবারে কারো (ফার্স্ট ডিগ্রি রিলেটিভ) কোলন ক্যান্সারের হিস্ট্রি থাকে
তবে এগুলো অন্য কোনো রোগের এমনকি কোলোরেকটাল ক্যান্সারের উপসর্গও নির্দেশ করে। এই লক্ষ্মণগুলোকে বলা হয় এলার্মিং ফিচার। সেক্ষেত্রে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং প্রয়োজনীয় টেস্ট করতে হবে।
এর চিকিৎসা পদ্ধতি?
শুধু ওষুধ গ্রহণ করেই এই রোগ নিরাময় করা সম্ভব নয়;সাথে লাইফস্টাইলেও কিছু পরিবর্তন আনতে হবে।
ডায়াগনোসিস নিশ্চিত হয়ে পেশেন্ট কে কাউন্সেলিং এবং রিএশিউর করতে হবে এইটা বড় কোনো রোগ (ক্যান্সার) না। কিছু নিয়ম মেনে চললে এবং চিকিৎসা নিলে আপনার জীবন ধারণের মান সহজ/উন্নত হবে।
রোগী কে জানাতে হবে দুশ্চিন্তা এরোগ কে এগ্রেভেট করে তাই যদি রোগী দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকতে পারে অনেকাংশে সুস্থ হয়ে যাবে।
যে সব খাবার খেলে IBS এর উপসর্গ দেখা দেয়, সেসব খাবার অবশ্যই পরিহার করতে হবে।
ইম্প্রুভ না হলে সিম্পটোমেটিক ট্রিটমেন্ট দিতে হবে।
ডায়েরিয়া প্রিডমিনেন্ট IBS-D হলে Anti- Diarrhoeal Drugs দিতে হবে আর
Constipation প্রিডমিনেন্ট IBS-C থাকলে laxatives যেমন ইস্পাগুলা হাস্ক যা বাজারে ইসবগুলের ভুসি নামে পাওয়া যায়।
Alternating Stool pattern থাকলে বা পেইন রিলিভের জন্য Spasmolytic Drugs দিতে হবে।
দুশ্চিন্তা মুক্ত রাখতে Anxiolytic দিতে হবে।
এগুলোতে ইম্প্রুভ না হলে উপসর্গ অনুযায়ী এন্টিবায়োটিক প্রেস্ক্রাইভ করা যেতে পারে।
উপদেশ
নিয়মিত এবং সময় নিয়ে খেতে হবে।
যারা মদ পান করে,মদ্যপান কমিয়ে দিতে হবে।
কিছু নির্দিষ্ট খাবার পরিহার করতে হবে, যেমন
১. Lactose exclusion diet অর্থাৎ দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, মিষ্টান্ন খাবার ইত্যাদি।
২. চকলেট, চা, কফি ও অন্যান্য ক্যাফেইনযুক্ত খাবার।
৩. Gluten free diet অর্থাৎ ময়দা থেকে তৈরী যেকোন খাবার, যথা ময়দার রুটি, বিস্কিট, ও অন্যান্য বেকারীজাত খাবার।
৪.অতিরিক্ত চর্বি জাতীয় খাবার, তৈলাক্ত খাবার কিংবা অন্যান্য তেলে ভাজা খাবার পরিহার করবে।
যেসব খাবারে IBS এর উপসর্গ দেখা দেয় তা পরিহার করতে হবে।
Constipation থাকলে ফাইবার জাতীয় খাবার যথা শাক বেশি বেশি খেতে হবে, ইসুপগুলের ভূসি ইত্যাদ খেতে হবে। তবে ডায়েরিয়া থাকলে এ খাবার গুলো এড়িয়ে চলতে হবে।
’low- FODMAP diet’ খাবারে অভ্যস্ত হতে হবে, প্রয়োজনে ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
যাদের সাইকিয়াট্রিক সমস্যা আছে প্রয়োজনে তাদের মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
দুশ্চিন্তা মুক্ত জীবন যাপন করতে হবে।