লোহিত কণিকার অন্যতম গাঠনিক উপাদান হিমোগ্লোবিন। আর এই হিমোগ্লোবিন উৎপাদনের অন্যতম কাঁচামাল আয়রন। কোন কারণে শরীরে আয়রন সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিলে এর প্রভাব পড়ে লোহিত রক্তকণিকা উৎপাদনে। দেখা দেয় রক্তাল্পতা বা এনেমিয়া (Anemia)। আয়রনের অভাবে এমন ঘটে বলে এর আরেক নাম আয়রনের অভাবজনিত রক্তাল্পতা (Iron Deficiency Anemia)
আয়রনের ঘাটতির কারণ কী
- আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে আয়রনের ঘাটতি দেখা দেয় অপুষ্টির কারণে। আয়রন আসে ডিম, দুধ ও মাংস হতে। সবজিতে থেকেও আয়রন পাই তবে আমাদের অন্ত্র তা ভালভাবে হজম করতে পারে না।
- উন্নত দেশে আয়রনের অভাবজনিত রক্তাল্পতার প্রধান কারণ ক্রনিক ডিজিজ বা কন্ডিশনে ধীরে ধীরে শরীর থেকে রক্তক্ষরণ হলে আয়রনের ঘাটতি তৈরি হয়।
- কৃমিতে আক্রান্ত হলে, ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া দীর্ঘদিন ব্যথার ওষুধ সেবন করলেও হতে পারে রক্তাল্পতা।
- অনেকে আছেন নিরামিষাশী। শাক-সবজি থেকে আয়রনের দৈনিক চাহিদা পূরণ না হলেও হতে পারে আয়রনের অভাবজনিত রক্তাল্পতা।
- গর্ভাবস্থায় বা নার্সিং মাদারের প্রয়োজন অতিরিক্ত আয়রন। এসময় পর্যাপ্ত আয়রন না পেলে দেখা দিতে পারে ঘাটতি।
- কিছু রোগ আছে যেখানে থাকে রক্তাল্পতার ঝুঁকি যেমন গ্যাস্ট্রিক আলসার, অন্ত্রের টিউমার, সিলিয়াক ডিজিজ, পাইলস।
- নারীদের ক্ষেত্রে মেন্সট্রুয়েশনের সময় দীর্ঘ হলে বা অতিরিক্ত রক্ত গেলে (ঋতুস্রাব)
লক্ষণ বা উপসর্গ
- দৈনন্দিন কাজকর্মে সমস্যা হতে পারে। অল্প কাজে ক্লান্তি, ঝাপসা দেখা, অবসন্নতা হতে পারে। কাজে মনোযোগ হারিয়ে ফেলা। শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার অমনোযোগী হতে পারে, ফলাফল খারাপ করতে পারে আয়রনের অভাবজনিত রক্তাল্পতা হলে।
- কিছুক্ষণ হাঁটলে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম, শ্বাসকষ্ট, বিশ্রাম নিলে ঠিক ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যায়।
- শরীর ফ্যাকাশে, বুক ধড়ফড় করা।
- দৈনিক খাদ্যাভাসে পরিবর্তন: খেতে ইচ্ছে করে না।
- আয়রনের ঘাটতি অনেকদিন হলে খাবার গিলতে সমস্যা হতে পারে, মুখে ঘা, নখ ভঙ্গুর হতে পারে।
কীভাবে রোগ নির্ণয় করা হয়
রক্তাল্পতা বা এনেমিয়ার কারণ নির্ণয়ের জন্য ডাক্তার কিছু টেস্ট করার পরামর্শ দিবেন।
- সিবিসি বা কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট থেকে রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ, লোহিত রক্তকণিকার আকৃতি ইত্যাদি তথ্য পাওয়া যায়।
- সিরাম ফেরিটিন থেকে শরীরে আয়রনের পরিমাণ কেমন আছে তার ধারণা পাওয়া যায়।
- দীর্ঘমেয়াদি রোগের ক্ষেত্রে কারণ অনুসন্ধানের জন্য এন্ডোস্কোপি, আল্ট্রাসনোগ্রাফিসহ অন্যান্য টেস্টের প্রয়োজন হতে পারে।
- রক্তরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শে প্রয়োজন হতে পারে বোন ম্যারো টেস্ট (অস্থিমজ্জার পরীক্ষা)।
কী চিকিৎসা দেয়া হয়
রক্তাল্পতার মাত্রা বা তীব্রতা অনুযায়ী মুখে আয়রন ওষুধ খেলেই সেরে যায়, কোন কোন ক্ষেত্রে শিরাপথে ওষুধ দেয়ার প্রয়োজন হতে পারে। ট্যাবলেট, ক্যাপসুল, সিরাপ ইত্যাদি ফর্মুলা আছে। ডাক্তার সিদ্ধান্ত নিবেন আপনার জন্য কোনটি উপযোগী এবং কোন মাত্রায় কতদিন চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। সাধারণত দিনে একবার ওষুধ সেবন করতে হয়। আয়রনের ঘাটতি পূরণ হতে অনেক ক্ষেত্রে ৩-৬ মাস এমনকি বছরও লেগে যেতে পারে। তবে চিকিৎসা শুরুর মাস খানেকের মধ্যে রক্তাল্পতার উপসর্গ কমতে থাকে, রোগী ভালো অনুভব করেন। নিয়মিত ফলোআপে থেকে চিকিৎসা নিলে আয়রনের অভাবজনিত রক্তাল্পতা থেকে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠা সম্ভব।
কী করবেন, কী করবেন না
- ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত আয়রন গ্রহণ করবেন।
- আয়রনের পাশাপাশি অন্যান্য ভিটামিনের প্রয়োজন হতে পারে, বিশেষ করে গর্ভাবস্থায় এবং শিশুকে বুকের দুধ পান করানোর প্রয়োজন হলে।
- সুষম খাদ্য খেতে হবে যেখানে পর্যাপ্ত আয়রন আছে যেমন মাংস, ডিম, সবুজ শাকসবজি ইত্যাদি।
- রোগের লক্ষণ বেশি হলে বা হঠাৎ তীব্র হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন জরুরি ভিত্তিতে।
- রক্তপাত হলে অবহেলা নয়। সাথে সাথে ডাক্তারের পরামর্শ বা জরুরি বিভাগে দেখা করুন।
- ওষুধ সেবনের ফলে পেটে সমস্যা, খাবারে অনীহা হলে ডাক্তারের সাথে আলাপ করুন। ওষুধের মাত্রা বা ফর্মুলা পরিবর্তন করলে এসব পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কাটিয়ে ওঠা যায় সহজে।