হার্ট পাম্প করে সারা শরীরে রক্ত সরবরাহ করে। মজার ব্যাপার হলো হার্টের নিজের কাজ ঠিক করার জন্যও প্রয়োজন হয় রক্তের। আরো নির্দিষ্ট করে বললে রক্ত ও এর মাধ্যমে বয়ে আসা অক্সিজেনের।
রক্ত ও অক্সিজেনের অভাব হলে হার্ট জানান দেয় নানা ভাবে। বুকে ব্যথা হলো তেমনি লক্ষণ। ডাক্তারি ভাষায় একে বলে এনজিনা (Angina)। ল্যাটিন শব্দ এনজিয়ার (angere) থেকে এসেছে এনজিনা শব্দ। এর অর্থ দম বন্ধ হয়ে আসা। এনজিনা যাদের হয় তারা এমন উপসর্গ নিয়ে আসেন, বলেন বুকে প্রচণ্ড চাপ, যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে।
যেসব রক্তনালীর মাধ্যমে হার্টে রক্ত সরবরাহ হয় একে বলে করোনারি আর্টারি (coronary artery)। বর্তমানে করোনা ভাইরাসের মহামারী চলছে। Corona আর coronary উৎপত্তিগত অর্থ Crown, মানে মুকুট। করোনারি আর্টারি হার্টকে এমনভাবে জড়িয়ে থাকে দেখতে মনে হয় হার্টকে মুকুট পরানো হয়েছে। (ছবি: coronary arteries) এসব রক্তনালীর ভিতরে কোলেস্টেরন ও ফ্যাট জমাট বেঁধে রক্ত সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটতে পারে, এ থেকে হতে পারে এনজিনা। (ছবি: coronary artery fat deposits)
স্বাভাবিক রক্তনালী, চর্বি জমাট বাঁধেনি, তবুও কি রক্ত সরবরাহে বিঘ্ন হতে পারে? হ্যাঁ, হতে পারে। করোনারি আর্টারির গঠন খেয়াল করলে দেখা যায় পরতে পরতে একে ঘিরে আছে মাংসপেশী। সব আর্টারির গঠনই এমন। এসব মাংসপেশীর সংকোচনে হার্টের রক্ত সরবরাহে বিঘ্ন ঘটতে পারে। করোনারি আর্টারির মাংসপেশীর এমন সংকোচনকে বলে স্পাজম (spasm)।
কিছু বুকে ব্যথা আছে হাঁটলে বা কাজ করলে বাড়ে, ওষুধ নিলে বা বিশ্রামে ব্যথা চলে যায়। বুকে ব্যথার গতিপ্রকৃতি অনুমান করা যায়। একে বলে স্টেবল এনজিনা (stable angina)। বেশির ভাগ বুকে ব্যথার রোগীরা এ ধরনের এনজিনাতে ভোগেন।
আরেক ধরনের এনজিনা আছে, যার গতিপ্রকৃতি অনুমান করা যায় না। হাঁটলেও বুকে ব্যথা থাকে, বিশ্রামেও কমে না, ওষুধেও সারতে চায় না। একে বলে unstable এনজিনা। এ ধরনের বুকে ব্যথা স্টেবল এনজিনার তুলনায় কম হয়। কিন্তু এর জন্য জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন।
কেন হয় এমন জরুরি অবস্থা, আনস্টেবল এনজিনা
জমাট বাঁধা রক্ত থেকে উৎপন্ন ক্লট রক্তনালী ব্লক করে দিতে পারে, এ থেকে শুরু হয় বুক ব্যথা। ক্লট নিজ থেকে ভেঙ্গে যেতে পারে। তখন চলে যায় বুক ব্যথা। ভাঙ্গা ক্লট থেকে নতুন ক্লট হতে পারে। সে ক্লট থেকে পুনরায় হতে পারে বুকব্যথা। ক্লটের চিকিৎসা না করালে ধীরে ধীরে পুরো রক্তনালী বন্ধ হয়ে যেতে পারে এবং এ থেকে হার্ট এটাক হতে পারে।
কীভাবে বুঝবেন আনস্টেবল এনজিনা: লক্ষণ, উপসর্গ
শুরুতে হতে পারে মৃদু উপসর্গ দিয়ে। মাঝারি বা তীব্রভাবে বুকে অস্বস্তি বা ব্যথা, বুকের মধ্যে চাপ, ভারী অনুভূত হওয়া। ব্যথা ছড়িয়ে পড়তে পারে বাহুতে, বিশেষ করে বাম পাশে। ঘাড়, কাঁধ বা চোয়ালে। দম বন্ধ হয়ে আসছে, শ্বাস নিতে কষ্ট এমন অনুভুতি হতে পারে। বমি ভাব, বমি, গায়ে ঘাম দেয় অনেকের।
শুধু দুর্বলতাও হতে পারে উপসর্গ, বিশেষ করে ডায়াবেটিসের রোগীরা হার্টের ব্যথার তীব্রতা কম অনুভব করেন। স্টেবল এনজিনাতে এসব উপসর্গ বিশ্রাম, ওষুধে কমে আসে। আনস্টেবল এনজিনাতে ব্যথা সারে না, তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী হতে থাকে। গতি প্রকৃতি বোঝা যায় না। হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হয়। নিবিড় তত্ত্বাবধানে রাখতে হয় (CCU).
ডাক্তার কীভাবে আনস্টেবল এনজিনা ডায়াগনোসিস করেন
ডাক্তার রোগ বৃত্তান্ত, শারীরিক পরীক্ষার ওপর নির্ভর করে প্রাথমিকভাবে ডায়াগনোসিস করবেন। আনস্টেবল এনজিনাতে হার্টের সেল ক্ষতিগ্রস্ত হলে এর কিছু কেমিক্যাল মার্কার রক্তে পাওয়া যায় ডাক্তার ল্যাব টেস্টের মাধ্যমে তা নিশ্চিত হবেন। ইসিজিতে আসতে পারে পরিবর্তন। বুকের এক্সরের প্রয়োজন হতে পারে।
পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য এমন জরুরি পরিস্থিতিতে অপেক্ষা করা সমীচীন নয়, তাই ডাক্তার প্রাথমিকভাবে রোগ ডায়াগনোসিস করার পর পরই চিকিৎসা শুরু করে দিবেন। পাশাপাশি হার্ট কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হলো তা বুঝার জন্য ল্যাব ও ইমেজিং ইত্যাদির জন্য অপেক্ষা করবেন এবং পরবর্তী ফলোআপে প্রয়োজনে চিকিৎসা ব্যবস্থা পুনর্বিবেচনা করবেন। হার্ট রেট, রক্তচাপ, অক্সিজেন লেভেল দেখা হয় এবং সিসিউতে থাকলে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হয়।
কীভাবে আনস্টেবল এনজিনার চিকিৎসা করা হয়?
জরুরি বিভাগের ডাক্তার ডায়াগনোসিসের পর প্রথমেই রোগীর জরুরি চিকিৎসা দিবেন। এতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে বুকে ব্যথা কমানোর ওষুধ, রক্ত জমাট বেঁধে রক্তনালী বন্ধ হওয়া ঠেকানোর ওষুধ, এবং অক্সিজেন লেভেল অনুযায়ী অক্সিজেন। হার্টের রক্তনালী প্রসারিত করতেও আছে ওষুধ নাইট্রোগ্লিসারিন যা ট্যাবলেট ও স্প্রে হিসেবে পাওয়া যায়। ডাক্তার প্রয়োজনে পরামর্শ দিবেন। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য ওষুধের প্রয়োজন হতে পারে, রোগ বৃত্তান্ত ও পরিস্থিতি অনুযায়ী ডাক্তার সিদ্ধান্ত দিবেন। কোলেস্টেরল ও ফ্যাট নিয়ন্ত্রণের জন্যও ব্যবস্থা নিতে হয় পরবর্তীতে।
অন্যান্য চিকিৎসার মধ্যে প্রয়োজন হতে পারে অপারেশনের। বেলুন এনজিওপ্লাস্টি, স্টেন্টিং, coronary artery bypass graft (CABG)। বেলুন এনজিওপ্লাস্টিতে বদ্ধ রক্তনালীতে বেলুনের মাধ্যমে প্রসারিত করা হয় এবং স্টেন্ট (টিউব) বসানো হয় যাতে রক্তনালী খোলা থাকে।
সিএবিজি-তে শরীরের ভিন্ন জায়গা থেকে রক্তনালী এনে ব্লক হওয়া রক্তনালীর সাথে বাই বাইপাস করা হয়।
আনস্টেবল এনজিনা রোগীর জন্য নির্দেশনা বা উপদেশ
• নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন, প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী সব ওষুধ নিয়মিত গ্রহণ করবেন
• ওজন বেশি হলে কমানোর চেষ্টা করবেন, পুষ্টিকর খাবার খাবেন
• বাইরে গেলে, অফিসে, ভ্রমণে সব সময় নাইট্রোগ্লিসারিন স্প্রে সাথে রাখবেন এবং দরকার পড়লে ব্যবহার করবেন
• ব্যায়াম করবেন, বুকে ব্যথা, চাপ অস্থিরতা হলে ব্যায়াম করবেন না। কখন ব্যায়াম করবেন ডাক্তার থেকে জেনে নিবেন
• ধূমপানের অভ্যাস থাকলে ছাড়তে হবে। ধূমপান ছাড়ার কিছু উপায় এ লিংকে পাবেন
• স্ট্রেসে, মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা করা যাবে না
• জরুরি প্রয়োজনে ডাক্তার দেখাতে দেরি করা ঠিক হবে না। এ ধরনের রোগীর হার্ট এটাকের ঝুঁকি থাকে। তাই জরুরি প্রয়োজনে কোথায় সেবা নিবেন, কোন ডাক্তার দেখাবেন, নিকটস্থ কোথায় সেবা পাওয়া যাবে তা আগে থেকেই ঠিক করে রাখুন। জরুরি নাম্বার, ঠিকানা সাথে রাখুন; সন্তান, বন্ধুবান্ধব, অফিসের কলিগ বিশ্বস্ত কাউকে আপনার অবস্থা জানিয়ে রাখুন, জরুরি প্রয়োজনে কী করতে হবে আগে থেকে জানিয়ে রাখুন।
• ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন বন্ধ করবেন না
• এক সপ্তাহের ওষুধ আগাম এনে রাখতে পারেন, নিকটস্থ ফার্মেসিতে বলে রাখুন আপনার ওষুধ যেন সব সময় রাখে। নিকটস্থ বা পরিচিত ফার্মেসির নাম্বার রাখুন। হঠাৎ ওষুধের প্রয়োজন হলে যেন দ্রুত ওষুধ পান।