রাত ৩ টার সময় শাওনকে ফোনে ডাক্তার জানালেন যে ওর বাবার শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেছে, অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে যাচ্ছে, এক্ষুনি আইসিইউ লাগবে। শাওন যথারীতি ডাক্তারের পরামর্শ মেনে বাবাকে কেবিন থেকে আইসিইউতে শিফট করলেন। শাওন জানত যে আইসিইউ কোন ভালো জায়গা না। প্রথমে একটু হেসিটেট করলেও ওয়ার্ডের ডাক্তার যখন বুঝিয়ে বললেন যে শ্বাসকষ্ট হলে উচ্চমাত্রার অক্সিজেন সহ যাবতীয় মেশিনারি সাপোর্ট শুধুমাত্র আইসিইউতে পাওয়া যায় তখন সে ব্যাপারটা বুঝতে পারলো।
আইসিইউ বা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র হচ্ছে যেকোন হসপিটালের সবচেয়ে জটিল কিংবা মরণাপন্ন রুগীদের সেবা পাওয়ার জায়গা। অন্যান্য কেবিন বা ওয়ার্ডে হসপিটাল ভেদে ১৫-২০ জন রুগীর জন্য ২-৩ জন নার্স এবং একজন ডাক্তার থাকেন, কিন্তু ইন্টারন্যাশানাল স্ট্যান্ডার্ড আইসিইউ বলতে যা বোঝায় সেখানে ১ জন রুগীর জন্য একজন নার্স এবং ৩-৪ জন রুগীর জন্য একজন ডাক্তার ডেডিকেটেড থাকেন। এর কারণ একটাই যে এখানকার সব পেশেন্ট অত্যান্ত ক্রিটিক্যাল থাকে এবং ওদের যে পরিমাণ সেবা যত্ন দরকার হয় সেটার জন্য অনেক সময় উপরোক্ত রেশিও-ও মাঝে মাঝে অপ্রতুল মনে হতে পারে। বাংলাদেশে এই স্ট্যান্ডার্ডের আইসিইউ আছে হাতে গোনা কয়েকটি। সেগুলো ব্যয়বহুল হওয়ায় সব শ্রেণীর মানুষজন ব্যয় বহন করতে পারেন না।
এখন আসুন শাওনের বাবার কী হল। কেবিন থেকে শিফটের কিছুক্ষণের মধ্যেই আইসিইউ’র ডাক্তার ওকে ফোন দিলেন। আইসিইউতে ভর্তি রুগীর ক্ষেত্রে হসপিটালের নিয়মনীতির কথা বললেন। বুঝিয়ে বললেন যে এখন ওর বাবার ৫০% অক্সিজেন লাগছে, এই সাপোর্ট যদি ৫০ থেকে বেড়ে ৯০ থেকে ১০০% লাগে সে ক্ষেত্রে প্লাস অন্যান্য শারীরিক কন্ডিশন বিবেচনায় এনে ওর বাবার নাকি লাইফ সাপোর্ট লাগতে পারে, এ ব্যাপারে শাওন বা ওর ফ্যামিলির অন্যান্যদের অনুমতি আছে কিনা। শাওনের স্ট্রেইট আন্সার ওর বাবার জন্য প্রটোকোল অনুযায়ী যা করা দরকার করবেন।
২ দিন পর শাওনের বাবা লাইফ সাপোর্টে যায় এবং ২৯ দিন পর গলায় ছোট ছিদ্র যেটার মেডিক্যাল টার্ম হচ্ছে ট্রাকিওস্টমি টিউব নিয়ে অনেকটা ভালো হয়ে ওয়ার্ডে ফেরত আসেন। এই দীর্ঘ জার্নিতে শাওন অনেক কিছু শিখলেন।
লাইফ সাপোর্ট মানেই মৃত্যু নয়
প্রথম ভয়ের ব্যাপার ছিলো লাইফ সাপোর্ট। লাইফ সাপোর্ট মানেই মৃত্যু নয়। এই ভয়াবহ স্ট্রেসফুল কন্ডিশন থেকে উঠে আসার ব্যাপারে আসলে পেশেন্টের বয়স, আসল আসুস্থতার পাশাপাশি অন্যান্য ক্রনিক অসুস্থতার মাত্রাসহ অনেকগুলো ফ্যাক্টর কাজ করে। এজন্যই ডাক্তারদের রেকমেন্ডেসন হচ্ছে প্রোটোকল অনুযায়ী সবার প্রয়োজন হলেও লাইফ সাপোর্ট সবার জন্য না। শাওনের বাবার পাশের বেডের ৯০ বছর বয়সী চাচাও লাইফ সাপোর্টে ছিলেন, কিন্তু ২ দিন পর উনি মারা যান।
ইনফেকশনের ঝুঁকি
দ্বিতীয় ব্যাপারটা যেটা শাওনের কাছে ইম্পরট্যান্ট লেগেছে সেটা হচ্ছে আইসিইউর ভেতর ইনফেকশনের ঝুঁকি। এ ব্যাপারে সবাইকে খুব সাবধানতা বজায় রাখতে বলা হচ্ছে। যে কারণে দিনে মাত্র ১ ঘণ্টা সময়, ভিজিটিং আওয়ারে সে তার বাবাকে দেখতে পেরেছে।
ইনফেকশন ব্যাপারটা এতই ভয়াবহ যে খুব সামান্য সমস্যা নিয়ে হস্পিটালে এসেও শুধুমাত্র ইনফেকশন কন্ট্রোল করতে না পেরে সেপসিস নামের রোগ নিয়ে আইসিইউতে এসে অনেক পেশেন্ট মারা যায়। এবং ২০২০ সালে শুধুমাত্র এই রোগে আইসিইউতে পেসেন্ট মারা যাবার হার নাকি প্রায় ৪৫%।
এখানে আরেকটা ব্যাপার মাথায় রাখা দরকার যে, ইনফেকশন কন্ট্রোলের ব্যাপারটা শুধুমাত্র হসপিটাল বা এর কর্মীদের উপর ডিপেন্ড করে না। সবাই সবার শতভাগ চেষ্টা করলেও এটা হতে পারে, যেমন কোভিড ১৯ রোগ। এত এত ভ্যাক্সিনের পরেও অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে কারন এই ভাইরাসের স্প্রেড করার এবং নিজেকে বার বার বদলে নেবার ক্ষমতার কারণে।
প্রতিদিনের আপডেট
সবশেষ ব্যাপার হল, প্রিপারেশন এবং কমিউনিকেশন। শাওনের বাবা আইসিইউতে ট্রান্সফারের পর প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিদিন তাকে আপডেট জানানো হত। ওভার ফোন এবং ভিজিটিং আওয়ারের পর সরাসরি। ইনফরমেশন গ্যাপ হবার কোন সুযোগ ছিলো না। কারো নিকটাত্মীয় এরকম ক্রিটিক্যাল অবস্থায় থাকলে তার সাথে কতটা সহানুভূতি নিয়ে কথা বলতে হয় এটা রেস্পেক্টেড ডাক্তারের জানা আছে। একই সাথে শাওনকেও ধারণা দেয়া হয়েছে যে আইসিইউতে ঢুকার পর যেকোন পেশেন্ট সব ধরনের আউটকাম ফেস করতে পারে। ডাক্তারেদের সর্বাত্মক চেষ্টার পরেও যেকোন হসপিটালের সবচেয়ে বেশি ডেথ হয় এই যায়গায়। সুতরাং ব্যাপারটা মেনে নেয়া প্রায় অসম্ভবের কাছাকাছি হলেও মাথায় রাখতে হয়।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় স্ট্যান্ডার্ড স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কী এবং এর সাথে কী পরিমাণ টাকা পয়সার ব্যাপার জড়িত এটা সবার ধারণায় থাকে না। সুতরাং আইসিইউর মত এক্সপেন্সিভ যায়গায় এ ব্যাপারটাও অবশ্যই চিন্তায় থাকা দরকার। সর্বোপরি সহানুভূতিশীল এবং একই সাথে প্রফেশনাল, অথোরিটি কিংবা ডাক্তার পেশেন্ট রিলেশনশিপ সবার জন্য মঙ্গল বয়ে আনুক।